বনরুই (Pangolin) আঁশযুক্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী। মুখে দাঁত না থাকায় পূর্বে দাঁতহীন স্তন্যপায়ী প্রাণীদের দলে অন্তর্ভুক্ত করা হতো। কিন্তু কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে বর্তমানে এদের আলাদা একটি দল ফোলিডোটার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার একমাত্র সদস্য বনরুই। পিঁপড়া ও পিঁপড়াজাতীয় প্রাণী খায় বলে আঁশযুক্ত পিঁপড়াভুক নামেও পরিচিত।
বনরুই আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। পৃথিবীতে ৭ প্রজাতির বনরুই রয়েছে, তন্মধ্যে এশিয়ায় আছে তিন প্রজাতির। এশীয় বনরুইদের ৩ প্রজাতিই বাংলাদেশে পাওয়া যায়।
পানির সঙ্গে তেমন একটা সম্পর্ক নেই, যদিও মাছের মতোই পুরো দেহ আঁশে ঢাকা থাকে; বরং মানুষের মতো স্তন্যপায়ী প্রাণী এরা। মুখে কোনো দাঁত নেই বলে আগে দাঁতহীন স্তন্যপায়ী প্রাণীদের দলে অন্তর্ভুক্ত করা হতো। কিন্তু কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে বর্তমানে এদের আলাদা একটি দল ফোলিডাটার (Pholidata) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার সদস্য একমাত্র বনরুইরাই।
বনরুই আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশের কোনো কোনো দেশের বাসিন্দা। এ দেশে তিন প্রজাতির বনরুই আছে, যেমন—দেশি, চীনা ও মালয়। এরা প্রধানত চিরসবুজ ও আধা চিরসবুজ বনে বাস করে। দেশি ছাড়া অন্য দুটি প্রজাতি সব জায়গায় দেখা যায় না। চীনা প্রজাতিটি চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট এবং মালয় বনরুই শুধু সিলেটের বনজঙ্গলে বাস করে। অত্যন্ত লাজুক ও নিশাচর বলে এ দেশে পর্যাপ্ত সংখ্যায় থাকা সত্ত্বেও প্রকৃতিতে বনরুইয়ের দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।
তিন প্রজাতির বনরুইয়ের মধ্যে আকারে দেশিগুলোই বড়। লেজ বাদে প্রায় ৬৬ সেন্টিমিটার লম্বা হয়; লেজটি হয় প্রায় ২০ সেন্টিমিটার। চীনা ও মালয়গুলো অপেক্ষাকৃত ছোট ও ছিপছিপে গড়নের হয়। ওজনে দেশি প্রজাতিটি ১০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। নাক ও দেহের নিচের দিক ছাড়া বাকি অংশ ১১-১৩ সারি শক্ত আঁশে আবৃত থাকে। আঁশের ফাঁকে ফাঁকে থাকে শক্ত লোম। লোমের পরিমাণ চীনাগুলোতে বেশি থাকে। দেশি বনরুইয়ের শরীরের রং হালকা বাদামি; আর চীনা ও মালয়গুলোর রং গাঢ় বাদামি। এ ছাড়া মালয়গুলোর আঁশের রং কিছুটা সাদাটে হয়ে থাকে। তবে নাক ও আঁশবিহীন অংশের রং কাঁচা মাংসের মতো লালচে হয়। ঘন আঁশের কারণে মালয় ছাড়া অন্য দুই প্রজাতির বনরুইয়ের কান দেখা যায় না।
এরা অত্যন্ত অদ্ভুত প্রাণী। মাটিতে বাস করলেও গাছে চড়তে ওস্তাদ, বিশেষ করে চীনা ও মালয়গুলো। বনরুই যখন কুঁজো হয়ে দুলতে দুলতে চলে, তখন মনে হয় কোনো জীবাশ্ম বা ফসিল বুঝি জীবিত হয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। এদের দেহ, বিশেষ করে লেজ, অত্যন্ত নড়নক্ষম। লম্বা এই লেজটি কোনো গাছের ডালে জড়িয়ে দিব্যি ঝুলে থাকতে পারে। আবার কোনো বিপদ দেখলে সামনের দুই পায়ের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে লেজ দিয়ে পুরো দেহ ঢেকে বলের মতো করে ফেলে। এ অবস্থায় গায়ের আঁশগুলো খাড়া হয়ে যায়। এভাবে দেহ একবার কুণ্ডলী পাকাতে ও সামনের পা দিয়ে কোনো কিছু আঁকড়ে ধরতে পারলে শক্তিশালী প্রাণীও সহজে এদের কোনো ক্ষতি করতে পারে না। আর এভাবেই এই নিরীহ প্রাণীটি শত্রুর হাত থেকে আত্মরক্ষা করে থাকে।
বনরুই অত্যন্ত অলস ও ধীরগতিসম্পন্ন প্রাণী। সারা দিন গর্তে ঘুমিয়ে কাটায় ও রাতে খাবারের খোঁজে বের হয়। খাবারের জন্য এরা মাটি শুঁকতে শুঁকতে এগোতে থাকে। পিঁপড়ার বাসা বা উইপোকার ঢিবির খোঁজ পেলেই শক্তিশালী থাবার নখের মাধ্যমে সেগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলে। এদের থাবায় পাঁচটি করে ধারালো নখ থাকে। বাসা বা ঢিবি ভাঙার পর প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার লম্বা আঠালো জিহ্বার সাহায্যে পিঁপড়া, উইপোকা, তাদের ডিম ও বাচ্চা খেতে থাকে। একটি পূর্ণবয়স্ক বনরুই এক রাতের শিকারে গড়ে পাঁচটি পিঁপড়ার বাসা বা উইপোকার ঢিবি সাবাড় করতে পারে।
এরা মাটির নিচে গর্ত করে বাসা বাঁধে। গর্ত ছয় মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এরা সাধারণত জোড় বেঁধে চলে ও বসন্তকালে বাচ্চা দেয়। প্রতিবার একটি করে বাচ্চা হলেও কখনো যমজ বাচ্চাও হতে পারে। বাচ্চা নিয়ে ঘোরাফেরার সময় মা লেজটিকে উঁচু করে তাতে বাচ্চাকে বসিয়ে নেয়। এ সময় বিপদ দেখলে বাচ্চাসহ এমনভাবে কুণ্ডলী পাকায় যে বাচ্চা আঁশের ফাঁকে ঢাকা পড়ে যায়। গারো পাহাড়, সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে বনরুই দেখতে পাওয়া যায়।বনরুইরা বর্তমানে এ দেশ থেকে বিলুপ্ত হতে বসেছে। কারণ, কোনো কোনো আদিবাসী সম্প্রদায়ের কাছে এদের মাংস অত্যন্ত প্রিয়। তা ছাড়া কিছু ভণ্ড কবিরাজ বনরুই মেরে দেহের বিভিন্ন অংশ থেকে তথাকথিত ওষুধ তৈরি করে এদের সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে। কাজেই বিলুপ্তির হাত থেকে এদের রক্ষা করার জন্য আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
তথ্যসুত্রঃ প্রথম আলো এবং উইকিপিডিয়া, ছবিঃ সংগৃহীত