গয়াল দক্ষিণ এশিয়ার একটি গরু জাতীয় বন্যপ্রাণী। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ক্রান্তীয় ও বৃষ্টিপাতের জঙ্গলে গরুজাতীয় বন্য প্রাণীর যত বৈচিত্র্য দেখা যায়, পৃথিবীর আর কোথাও তেমনটি দেখা যায় না। এই এলাকায় বুনো মোষ, গাউর, গয়াল, বানটেং ও কোপরে নামের বন্য গরুগুলোর বিকশিত হওয়ার কারণ প্রচুর বৃষ্টিপাত, ঘন গাছপালা ও ঘাসের জঙ্গল। এদের খাবারের জন্য প্রচুর ঘাস ও লতাপাতার প্রয়োজন হয়। এই এলাকাগুলোতে তা পাওয়া যায় আর প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে ঘাস-পাতাও দ্রুত গজিয়ে ওঠে।
বিশাল এই প্রাণীগুলোর তিনটি বুনো মোষ, গাউর ও গয়াল বাংলাদেশে গত শতাব্দীর ত্রিশের দশক পর্যন্ত পাওয়া যেত। বর্তমানে বুনো মোষ বিলুপ্ত হয়েছে। গাউর অতিবিপন্ন, দু-চারটে পার্বত্য চট্টগ্রাম-সীমান্তবর্তী অঞ্চলে থাকলেও থাকতে পারে। তবে বিগত বছর চারেকের মধ্যে গাউরের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এমনকি গয়ালও বিপন্ন। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাবলাখালী, সাজেক ভ্যালি ও মিয়ানমারের সীমান্তসংলগ্ন পাহাড়ি বনে গয়ালের বিচরণ রয়েছে। মাঝেমধ্যে আদিবাসীরা দু-একটি গয়ালের খোঁজ পায় এবং শিকার করে বলেও জানা গেছে।
প্রখ্যাত প্রকৃতিবিদ চা-চাষি ই পি গির ওয়াইল্ড লাইফ অব ইন্ডিয়া (১৯৬৫) বইয়ে গয়ালের উল্লেখ আছে। এই গি মহাশয়ই ভারতের আসামে মানাস জঙ্গলে সোনালি হনুমান আবিষ্কার করেন। এই হনুমানের বৈজ্ঞানিক নামকরণ Presbytis geei করা হয় ই পি গির নামে।
১৯৬৭ সালে গাই মাউন্টফোর্ট তৎকালীন পাকিস্তান ও বর্তমান বাংলাদেশের বন্য প্রাণীর ধরন জানতে পাবলাখালীতে গয়ালের সন্ধান পান এবং ছবি তোলেন। গি ও মাউন্টফোর্ট উভয়েই গয়ালকে গাউর ও দেশি গরুর মিশ্রণ বলে শনাক্ত করেন।
কিন্তু গয়াল পুরোপুরি বন্য জীব। এদের বৈজ্ঞানিক নাম Bos frontalis.
আমি খুঁটিয়ে লক্ষ করেছি, গাউরের সঙ্গে গয়ালের আকৃতির বেশ পার্থক্য আছে। গয়ালের দেহের লোমের রং কালো থেকে গাঢ় বাদামির মধ্যে, সামান্য হেরফের হয়। গাউরের দুই শিঙের মধ্যে ঢিবির মতো আছে, যা গয়ালের নেই। গাউরের শিং অপেক্ষাকৃত ছোট এবং ওপরের দিকে ভেতরমুখী বাঁকানো। গয়ালের শিং দুই পাশে ছড়ানো, সামান্য ভেতরমুখী বাঁকানো। শিঙের গোড়া অত্যন্ত মোটা। গাউর বা বুনো মোষের মতো গয়ালের হাঁটুর কাছ থেকে ময়লা সাদা লোম নেই। গয়ালের কাঁধে গরুর মতো কুঁজ নেই, বরং গাউরের মতো পিঠের ওপর ছড়ানো পাহাড়ের ঢালের মতো ঢিবি আছে। এদের খুর অবশ্য গাউরদের মতো অপেক্ষাকৃত ছোট এবং আঁটোসাঁটো।
গয়াল বেশ বড় প্রাণী। পূর্ণবয়স্ক পুরুষ গয়াল ৭০০ থেকে ৮০০ কেজি ওজনের হতে পারে। এরা ঘাস ও পাতা দুই ধরনের খাবারই খায়। এরা সাধারণত হাতির সহবাসী। হাতির দল চলতি পথে গাছের ডাল ভাঙে, ছোট গাছ উপড়ে ফেলে ফল-পাতার কিছু অংশ খায়। বাকিটায় ভাগ বসায় গয়াল, শম্বর হরিণ। ভোর থেকে শেষরাত পর্যন্ত এরা পাহাড়ি জঙ্গলের প্রান্তে দ্রুত খাবার খায় মাংসাশী জানোয়ারের হাত থেকে বাঁচার জন্য। দিনের বেলায় ঘন জঙ্গলে জাবরকাটে। শক্ত ও কর্কশ ঘাস খাওয়ায় এদের দাঁত দ্রুত ক্ষয় হয়। এই ক্ষয় পূরণে এদের ক্ষার ও লবণযুক্ত মাটি খেতে হয়। অবশ্য লবণ খায় অন্ত্রের পোকা কমানোর জন্য।
উত্তরে ভারতের অরুণাচল প্রদেশ থেকে দক্ষিণে বাংলাদেশ-মিয়ানমার-সীমান্ত এলাকা পর্যন্ত এদের বিস্তৃতি। অনেক বিজ্ঞানী প্রশ্ন তুলেছেন, এরা যদি সংকর প্রজাতির হবে, তাহলে ভারতের গাউর অধ্যুষিত মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, দক্ষিণ ভারত ও নেপালে গয়ালের উৎপত্তি হয়নি কেন? তাঁদের বিশ্বাস, গয়াল কোনো একটি হারানো গো-প্রজাতির উত্তরসূরি। অন্যান্য গো-জাতীয়দের মতো গয়ালদের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হলেও এদের শ্রবণ ও ঘ্রাণ বিশ্লেষণের শক্তি অসাধারণ। এরা ছোট দলে বাস করে এবং স্থাণিক প্রাণী নয়।
ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে সফলভাবে গয়ালের কৃত্রিম প্রজনন করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে এখানে বয়স্ক তিনটি পুরুষ গয়াল ও একটি মেয়ে গয়াল রয়েছে। অতিরিক্ত মেদ এবং বয়সের কারণে এরা মিলিত হতে আগ্রহী নয়। ফলে এখানেও প্রজাতিটি বিলুপ্ত হতে চলেছে।
প্রাকৃতিক পরিবেশে গয়ালেরা কীভাবে আছে। এদের সংখ্যা কত—এ ব্যাপারে কোনো বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান হয়নি। বুনো মোষ হারিয়ে গেছে চিরতরে। গাউরও যাবার পথে। গয়ালকে টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নিলে হারিয়ে যাবে আমাদের পাহাড়ি বনের এই বিশালাকার অতীব সুন্দর প্রাণীটি।