নিঝুম দ্বীপ ! নাম শুনলেই অজানা এক শিহরণে কেপে ওঠে মন! চারদিকে সমুদ্র, নদীর মোহনা, কেওড়া বন আর সহস্র হরিণের অভয়াশ্রম এই নিঝুম অরন্য! সকালে ঘুম থেকে জেগে শুনতে পাবেন অসংখ্য পাখির কলতান। নির্মল সূর্যোদয়। দুপুরের সোনারোদে বনের ভেতরের রূপ দেখে বিহবল হতে হবে যে কোন পর্যটককে। হঠাৎ হয়তো দেখবেন গাছের ফাঁকে একচিলতে সোনালি ঝিলিক! হরিন! ওদের মায়াবী চোখ দেখে মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যাবেন। যখন সম্বিৎ ফিরবে, তখন কিছুই নেই! এ যেন প্রকৃতির সাথে লুকোচুরি! এখানে বিকেল আসে মায়াবী রূপ নিয়ে। সন্ধায় দূর ‘কবিরার চর’রের উপর দিয়ে সূর্য যখন অস্ত যাবে, সেই দৃশ্য নিশ্চিত ভাবেই আপনার দেখা শ্রেষ্ঠ সূর্যাস্ত হবে! এখানে রাত নামে আরও বিপুল সৌন্দর্য আর ঐশ্বর্য নিয়ে। বনের উপর দিয়ে থালার মত পূর্ণিমার চাঁদের আলো এসে আপনার দেহ-মন জুড়িয়ে দেবে। সেই দৃশ্য স্বর্গীয়, সেই অনুভুতি অপার্থিব!
তাই আসুন, বেড়িয়ে যান বাংলার স্বর্গ নিঝুম দ্বীপে। দেখুন নিজেকে। দেখুন বাংলাদেশকে।

নিঝুম দ্বীপ বাংলাদেশের একটি ছোট্ট দ্বীপ। নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার অর্ন্তগত নিঝুম দ্বীপ। নিঝুম দ্বীপের পূর্ব নাম ছিলো চর-ওসমান।ওসমান নামের একজন বাথানিয়া তার মহিষের বাথান নিয়ে প্রথম নিঝুম দ্বীপে বসত গড়েন। তখন এই নামেই এর নামকরণ হয়েছিলো। পরে এই নাম বদলে নিঝুম দ্বীপ নামকরণ করা হয়।মূলত বল্লারচর, চর ওসমান, কামলার চর এবং চুর মুরি- এই চারটি চর মিলিয়ে নিঝুম দ্বীপ। প্রায় ১৪,০০০ একরের দ্বীপ ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে জেগে ওঠে। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের আগ পর্যন্ত কোনো লোকবসতি ছিলো না, তাই দ্বীপটি নিঝুমই ছিলো। বাংলাদেশের বনবিভাগ ৭০-এর দশকে বন বিভাগের কার্যক্রম শুরু করে। প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে চার জোড়া হরিণ ছাড়ে। নিঝুম দ্বীপ এখন হরিণের অভয়ারণ্য। ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দের হরিণশুমারি অনুযায়ী হরিণের সংখ্যা ২২,০০০। নোনা পানি বেষ্টিত নিঝুম দ্বীপ কেওড়া গাছের অভয়ারণ্য। ম্যানগ্রোভ বনের মধ্যে সুন্দরবনের পরে নিঝুম দ্বীপকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন বলে আখ্যায়িত করা হয়।

নিঝুম দ্বীপে হরিণ এবং মহিষ ছাড়া অন্য কোনো হিংস্র প্রাণী নেই। হরিণের সংখ্যা প্রায় ২২,০০০। নিঝুম দ্বীপে রয়েছে প্রায় ৩৫ প্রজাতির পাখি।এছাড়াও শীতের মৌসুমে অজস্র প্রজাতির অতিথির পাখির অভয়ারণ্যে পরিণত হয় নিঝুম দ্বীপ। নিঝুম দ্বীপে বিশাল এলাকা পলিমাটির চর। জোয়ারের পানিতে ডুবে এবং ভাটা পড়লে শুঁকোয়। এই স্থানগুলোতে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখিদের বসবাস। জোয়ারের পানিতে বয়ে আসা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ এদের একমাত্র খাবার।এছাড়াও রয়েছে প্রায় ৪৩ প্রজাতির লতাগুল্ম এবং ২১ প্রজাতির অন্যান্য গাছ।

যেভাবে যাবেনঃ
ঢাকা থেকে দুইভাবে নিঝুম দ্বীপ আসা যায়।
সড়ক পথের রুটঃ ঢাকা-সোনাপুর(নোয়াখালী)-চেয়ারম্যান ঘাট-হাতিয়ার নলচিরা ঘাট(সী-ট্রাক বা ট্রলারে)-হাতিয়ার অপর প্রান্ত জাহাজমারা বাজার-নিঝুম দ্বীপ যাবার ঘাট(খেয়া পারাপার)-নিঝুম দ্বীপ বন্দরটিলা ঘাট-নামার বাজার।
ঢাকার সায়দাবাদ এবং কমলাপুর থেকে প্রতিদিন অসংখ্য বাস নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। সময় লাগে ৫-৬ ঘণ্টা। ভাড়া বাস ভেদে ২৫০- ৩৫০ টাকা। সোনাপুর নেমে আবার বাসে চেয়ারম্যান ঘাট। সময় লাগবে ২ ঘণ্টার মত। ভাড়া ৬০-৮০ টাকা। চেয়াম্যান ঘাট থেকে প্রতিদিন দুপুর ২ টার দিকে হাতিয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় সি ট্রাক। সেগুলোতে চড়ে চলে যাবেন হাতিয়া। ভাড়া নেবে চেয়ারে ১৫০ টাকা এবং ডেকে ১০০ টাকা। সময় লাগবে ১.৩০ মিনিট। আপনাকে হাতিয়ার যে ঘাটে নামিয়ে দেবে সে ঘাটের নাম ‘নলচিরা ঘাট’। নলচিরা ঘাট থেকে ‘চান্দের গাড়িতে’ যাবেন হাতিয়ার অপর প্রান্ত জাহাজমারা বাজার। সময় লাগবে ৩ ঘণ্টার মত। ভাড়া নেবে ৮০-১০০ টাকা। জাহাজমারা বাজারে রাতে থাকবেন। এখানে থাকার জন্য তেমন ভালো হোটেল নেই। যেগুলো আছে সেখানে কষ্ট করে থাকতে হবে। ভাড়া নেবে ১০০-১২০ টাকা জনপ্রতি। সকালে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার জন্য আপনাকে ঘাটে যেতে হবে। সেক্ষেত্রে মোটরসাইকেল ছাড়া আর কোন যানবাহন নেই। একটি মোটরসাইকেলে তিনজন পর্যন্ত উঠা যায়। ভাড়া জন প্রতি ৬০-৮০ টাকা। পূর্বেই দরদাম করে নেবেন। ঘাটে পৌঁছাতে সময় লাগবে ৩০ মিনিটের মত। ঘাটে দাঁড়ালেই অপর পাশে দেখতে পাবেন স্বপ্নের নিঝুম দ্বিপের বনাঞ্চল। সকাল ৯ টায় নিঝুম দ্বীপ যাবার নৌকা ছাড়ে। ভাড়া ২০-৩০ টাকা। সময় লাগবে ৩০ মিনিট। নদী পার হওয়ার পথে অসংখ্য পাখি দেখতে পাবেন। নিঝুম দ্বীপে আপনাকে নামিয়ে দেবে যে ঘাটে তার নাম ‘বন্দরটিলা ঘাট’ নেমে মোটরসাইকেলে সরাসরি চলে যাবেন ‘নামার বাজার’। ভাড়া জনপ্রতি ১০০ টাকা। (যাতায়াত এবং ভাড়া সংক্রান্ত তথ্যগুলো মার্চ-২০১৩ সালের)
নৌ পথেঃ ঢাকা-তমরুদ্দি(হাতিয়া)-হাতিয়া বন্দরটিলা-নিঝুম দ্বীপ বন্দরটিলা-নামার বাজার।
ঢাকা থেকে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার সহজ রুট সদরঘাট থেকে লঞ্চে করে হাতিয়ারতমরুদ্দি। এ পথে এমভি পানামা এবং এমভি টিপু-৫ নামে দুটি লঞ্চ নিয়মিত চলাচলকরে। যোগাযোগের ফোন-০১৯২৪০০৪৬০৮ এবং ০১৭১১৩৪৮৮১৩।
ভাড়া ডাবলকেবিন ১২০০ আর সিঙ্গেল ৬৫০ টাকা। ডেকে জনপ্রতি ২০০ টাকা খরচ হবে। ঢাকা থেকে ছাড়ে বিকেলে আর তমরুদ্দি থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছাড়ে দুপুর সাড়েবারোটায়। আর তমরুদ্দি থেকে স্কুটারে বন্দরটিলা ঘাট খরচ হবে ৪৫০-৫৫০ টাকা।স্কুটার ছাড়া বাস এবং রিকসা করেও বন্দরটিলা ঘাটে যাওয়া যায়। বাস ভাড়া ৩০-৪০ টাকা, রিকসা ভাড়া ৫০-৬০ টাকা।সেখান থেকে ট্রলারে চ্যানেল পার হয়েনিঝুম দ্বিপের বন্দরটিলা । সেখান থেকে মোটরসাইকেলে নামারবাজার।

কোথায় থাকবেনঃ
নিঝুম দ্বীপে আপনাদের থাকার জন্য আদর্শ স্থান ‘নামার বাজার’। এখান থেকে আপনি খুব সহজেই মূল বনে ঢুকতে পারবেন। এছাড়া এই এলাকাটি দক্ষিণ প্রান্তে হওয়ায় আপনি সাগরের কাছাকাছি থাকতে পারবেন।
থাকার জন্য নামার বাজারের উত্তরে রয়েছে অবকাশ পর্যটনের ‘নিঝুম রির্সোট’ । এখানে ২ শয্যার কক্ষ ভাড়া ১০০০ টাকা, ৩শয্যার কক্ষ ১২০০ টাকা, ৪ শয্যার কক্ষ ১৮০০ টাকা, ৫ শয্যার ডরমিটরির ভাড়া১০০০ টাকা, ১২ শয্যার ডরমিটরি ২৪০০ টাকা। ঢাকা থেকে এ রিসোর্টের বুকিং দেয়াযায়। যোগাযোগঃ অবকাশ পর্যটন লিমিটেড, শামসুদ্দিন ম্যানশন, ১০ম তলা, ১৭ নিউইস্কাটন, ঢাকা। ফোন- ৮৩৫৮৪৮৫, ৯৩৪২৩৫১, ০১৫৫২৪২০৬০২।
এছাড়া, ‘মসজিদ বোডিং’। বাজারের উত্তর প্রান্তে মসজিদ বোডিংএ থাকলে ভাড়া পড়বে মাত্র ৬০-৮০ টাকা জন প্রতি। এখানে রুমগুলো পরিপাটিএবং সুন্দর। রয়েছে গোসলের সুব্যবস্থা। আর মসজিদের ইমামের অনুমতি নিয়ে কম দামে সুস্বাদু ডাব খেতে পারবেন।
তাছাড়া বন বিভাগেরবাংলো, জেলা প্রশাসকের ডাকবাংলো, রেড-ক্রিসেন্ট ইউনিট ও সাইক্লোন সেন্টারেওথাকার ব্যবস্থা করা যায়। তবে এগুলোর জন্য পূর্বেই অনুমতি নিতে হয়।


কোথায় খাবেনঃ নিঝুম রিসোর্টে খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। নামার বাজারে তেমন ভালো কোন খাবার হোটেল নেই। যেগুলো আছে সেগুলোতে খেতে পারেন, তবে আগেই কথা বলে নেবেন। এতে তাজা খাবার পাওয়া যাবে। বিভিন্ন ধরনের মাছ দিয়ে খেলেও ৫০-৬০ টাকার বেশি খরচ হবে না।
এছাড়া নিজেরাও বাজার করে রান্না করে খেতে পারেন। নিঝুম দ্বীপ থেকে ফেরার পথে এখানকার বিখ্যাত শুঁটকি কিনে নিতে পারেন।
