অসংখ্য গারো রূপকথা প্রচলিত আছে গারো সমাজে। বীর বিক্রম হামিদুল হোসেনের সৌজন্যে তেমনই একটি রুপকথা আমাদের পাঠকদের জন্য দেয়া হল।
অনেক অনেক দিন আগের কথা। ময়মনসিংহের সুসংর্দুগাপুর এলাকায় গারোপাহাড়ের এক নিভৃত গ্রামে বাস করত এক যাদুকর। তার ছিল চারটি ছেলে। যাদুকর মারা যাবার সময় তার ছেলেদের বলল, বাবারা তোমরা শোন, আমার কাছে চারটা যাদুর ঢোল আছে। একটা সোনার ঢোল, একটা রুপোর ঢোল, একটা তামার ঢোল আর একটা টিনের ঢোল। তোমাদের চারজনকে আমি এই চারটি ঢোল দিয়ে যাব। এই চারটি ঢোলের যাদুর ক্ষমতা আছে। সেই ক্ষমতাবলে তোমাদের ভাগ্য ফিরে যাবে। তবে আমি জানিনা কার ভাগ্যে এই যাদুর ঢোল কি এনে দেবে এবং কে সুখের ভেতর দিয়ে জীবন যাপন করবে। আমি মারা যাবার পর তোমরা এই ঢোল নিয়ে গারো পাহাড়ের গভীর বনে চলে যাবে। সেখানে দেখবে এক জায়গায় র্গজন গাছের বন, একখানে আছে শালবন, একখানে আছে চিনার গাছের বন ও আর একখানে আছে র্অজুন গাছের বন। এই বনে গিয়ে ঢোল বাজাতে হবে। এই বলে যাদুকর মারা গেল।
যাদুকর মারা যাবার পর তার চার ছেলের মধ্যে বড়ছেলে বলল, আমি বড়ছেলে সুতরাং আমি সোনর ঢোল নেব। মেঝভাই নিল রুপোর ঢোল, সেজছেলে নিল তামার ঢোল আর ছোট ছেলে পেল টিনের ঢোল। চার ভাই ঢোল নিয়ে গারো পাহাড়ের গভীর বনে চলে গেল। বড়ভাই র্গজন গাছের বনে ঢুকে ডিম-ডিম করে ঢোল বাজাল। ঢোল বাজানোর সাথে সাথে ঢোলের ভেতর থেকে এক র্বমপরা সৈন্য। সৈন্যটি তলোযার উচিয়ে বলল, আমি তোমার দাস, তুমি আমার মনিব, বলো তুমি কি চাও? আমার যাদুর ক্ষমতায় আমি সেটা তোমাকে দিতে বাধ্য। বড়ছেলে বলল, আমাকে একটি রাজ্য দাও যে রাজ্যের রাজা হব আমি। তার সাথে সৈন্য সামন্ত, হাতি ঘোড়া পাইক পেয়াদা সব দাও। – জি আজ্ঞে হুজুর, এইবলে যাদুর সৈন্যটি আকাশের দিকে তলোয়ার উচিয়ে বলল, আমার মনিব যা যা চেয়েছে হয়ে যাও। সঙ্গে সঙ্গে বন হতে দুরে একটি রাজ্য হয়ে গেল। সেখানে সৈন্য সামন্ত, পাইক পেয়াদা, সব হয়ে গেল। বড়ছেলে রা্জা হয়ে সিংহাসনে আরোহণ করল। মেঝছেলে শালবনের ভেতর গিয়ে ডিম-ডিম করে ঢোল বাজাল। সাথে সাথে ঢোলের ভেতর হতে বেরিয়ে এলো এক সৈন্য। সে বলল- আমি তোমার দাস তুমি আমার মনিব। আদেশ কর কি চাই। মেঝছেলে বলল, আমাকে প্রচুর সোনাদানা, হীরে মানিক ও ধনদৌলত দাও। যেটা দিয়ে আমি একটি রাজ্য কিনে রাজা হব। মেঝছেলেও ধনদৌলত পেয়ে একটি রাজ্য কিনে রাজা হয়ে গেল। সেজছেলে চিনার বনের ভেতর গিয়ে ঢোল বাজাতেই আবার একটি সৈন্য বেরিয়ে এলো। সে সৈন্য কে বললু আমাকে সমুদ্রগামী জাহাজ, নাবিক, সোনাদানা আর প্রচুর ধনদৌলত দাও আমি সওদাগরী ব্যবসা করবো এবং দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াব। যাদুর সৈন্য তাকে সবকিছু দিলে সেও জাহাজে চড়ে রওনা দিল। এবার ছোট ছেলের পালা। সে র্অজুন গাছের বনের ভেতরে গিয়ে ঢোল বাজাতেই বেরিয়ে এলো এক পরীর মতো সুন্দর রাজকন্যা। রাজকন্যা বলল – আমার নাম বনকুসুম। এই বনে যে নানা রকম পারিজাত, নাগকেশর, বনতোষনী, বনওকরা, মধুমালতি, বকুল যুঁই, পলাশ,শিমুল ও অন্যান ফুল দেখছ সেই ফুল রাজ্যের রাজকন্যা আমি। এখন বল তুমি কি চাও। তোমার ভাইদের মতো ধন দৌলত, রাজ্য না আমাকে নিয়ে এই বনে বাস করতে। ছোটছেলের নাম ছিল সজিব দ্রং। সে বলল- আমি ধনদৌলত, রাজ্য, কিছুই চাই না। আমি তোমার সাথে এই বনেই বাস করতে চাই। এরপর তারা দুজনে বনের মধ্যে একটি বাড়ি বানালো। বাড়ির সামনে ফুলের বাগান। তার ধারে পুকুর। পুকুর র্ভতি লাল পদ্য ফুল। ফুলবাগানে নানা রং এর ফুল। হাজারো পাথির কিচির মিচির। কাঠবিড়ালীর ছুটোছুটি। রাতের আধারে হাজারো জোনাকি পোকা পিটপিট আলো জ্বেলে নেচে বেড়ায়। এদের সাথে আনন্দে কাটতে লাগলো ওদের সুখের জীবন।
অনেকদিন ভাইদের সাথে দেখা নেই তারা কেমন আছে তাই জানার জন্য একদিন সজিব দ্রং বড়ভাই এর রাজ্যে এলো। বড়ভাই খুব খুশি ছোট ভাইকে পেয়ে। বড়ভাই এর বিশাল রাজ্য । সৈন্য সামন্ত। আধিপত্য সবকিছু আছে। কিন্তু এতো বড় রাজ্যের রাজা হয়েও বড়ভাই এর মনে সুখ নেই। সারাদিন মনমরা হয়ে রাজপ্রসাদের ভেতরে থাকে। বড়ভাই তাকে জানালো তার মন্ত্রি ও সেনাপতি গোপনে তাকে মেরে ফেলে সিংহাসন দখল করার যড়যন্ত্র করছে। তাই সে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে কোথাও বের হয় না। এইকথা শুনে সজিব দ্রং খুব দুঃখ পেল। সে বলল – এসব রাজ্য,ধনদৌলত ছেড়ে দিয়ে চলে এসো গারো পাহাড়ে। সুখে বাস করতে পারবে। বড়ভাই বলল – এইজন্যই বাবা বলেছিল কে জীবনে সুখি হবে আমি জানিনা। আসলে তুই বনকুসুমকে নিয়ে নিশ্চয় সুখে আছিস। এরপর সজিব দ্রং মেঝভাই এর রাজ্যে গেল। মেঝভাই তাকে খুব আদরে গ্রহন করল। মেঝভাই এর ও অবসহা একই রকমের। তার চার রানি। ছোট রানি হচ্ছে রাজ্যের সেনাপতির বোন। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে তারা লিপ্ত। ছোটরানি সেনাপতি ভাই এর সাহায্যে রাজাকে মেরে ফেলে নিজেই সিংহাসন দখল করতে চায়। এব্যাপারে রাজা খুবই উদ্বিঘ্ন। রাতে ঘুম নেই। মনে শান্তি নেই । সজিব দ্রং তাকেও বলল- এসব ছেড়ে দিয়ে গারো পাহাড়ে চলে এস। এরপর সে গেল সেজভাই এর কাছে। সে এখন আর জাহাজ নিয়ে বানিজ্য করতে যায় না। কারণ তার নাবিকরা জলদস্যুদের সাথে ষড়যন্ত্র করে তাকে হত্যা করে তার ধনসম্পদ লুন্ঠন করতে চাচ্ছে। তাকেও সে বলল – এসব ধনদৌলত ছেড়ে গারো পাহাড়ে চলে এস।
একদিন সত্যি সত্যিই তিনভাই চলে এলো। তারা দেখতে পেল বনের ভেতরে তাদের ছোটভাই তার স্ত্রী বনকুসুম কে নিয়ে খুব সুখেই দিন কাটাচ্ছে। তারাও আর গারো পাহাড় ছেড়ে গেলনা। বনকুসুমের তিন বোনকে তিনজনে বিয়ে করে আবার সুখে দিন কাটাতে লাগল। সহজ সরল জীবন সুন্দর সুখী জীবন।
সুত্রঃ আদিবাসী রূপকথা, হামিদুল হোসেন তারেক (বীরবিক্রম), রোদেলা প্রকাশনী
আরও দেখুনঃ রানবংশী রূপকথা