সতর্কতাঃ অতিরিক্ত পর্যটকের চাপে ও প্রবল দূষণে প্রবাল ও জীববৈচিত্রে সমৃদ্ধ সেন্ট মার্টিন দ্বীপ আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বর্তমানে প্রতিদিন এই ছোট্ট দ্বীপে গড়ে ৪ হাজার পর্যটক যাতায়াত করছেন। তাদের ফেলে যাওয়া বর্জ্য, মলমুত্র প্রতিনিয়ত সমুদ্রের পানিকে দুষিত করে চলেছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই সেন্ট মার্টিন প্রবাল ও জীববৈচিত্র শূন্য হয়ে পড়বে। তাই আমরা এই আর্টিকেলের শুরুতে আপনাকে সেন্ট মার্টিন ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করছি।

সেন্ট মার্টিন বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। চারদিকে নীল জল আর পশ্চিমের পাথুরে সৈকত সেন্ট মার্টিনকে দিয়েছে অনন্যতা। সেন্ট মার্টিন বাংলাদেশের একমাত্র স্থান, যেখান থেকে সত্যিকারের নীল সমুদ্র আর সাদা বালির সৈকত দেখা যায়। উত্তর-দক্ষিণে লম্বা প্রায় ৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই এ দ্বীপের তিন দিকে রয়েছে দীর্ঘ প্রবাল প্রাচীর, যা জোয়ারের সময় তলিয়ে যায় এবং ভাটার সময় জেগে ওঠে। এগুলোকে ধরলে এর আয়তন হয় প্রায় ১০-১৫ বর্গ কিলোমিটার। সেন্ট মার্টিনের দক্ষিণ প্রান্তে তিনটি ডুবো দ্বীপের সমন্বয়ে ছেঁড়া দ্বীপ নামে আরেকটি অংশ রয়েছে। জোয়ারের সময় মূল দ্বীপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও ভাটার সময় হেঁটেই সেগুলোতে যাওয়া যায়। ছেঁড়া দ্বীপ জীব বৈচিত্র, জীবন্ত প্রবাল আর নানা প্রজাতির মাছে সমৃদ্ধ। কক্সবাজার উপকূল হতে ৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে সেন্ট মার্টিন অবস্থিত। ১৯৯০ সালের আগ পর্যন্ত সেন্ট মার্টিন দেশের পর্যটকদের কাছে তেমন পরিচিত ছিল না। তখন দ্বীপের স্থানীয়দের একমাত্র পেশা ছিল সাগরে মাছ ধরা। একসময় প্রচুর নারকেল গাছ ছিল বলে স্থানীয়রা দ্বীপের নাম দিয়েছিল নারকেল জিঞ্জিরা, পরে ১৯০০ সালের দিকে ইংরেজরা এর নাম দেয় সেন্ট মার্টিন।

কীভাবে যাবেন:
স্থলপথে সরাসরি সেন্ট মার্টিন যাওয়া যায় না। ঢাকা থেকে সড়কপথে সরাসরি কক্সবাজারের টেকনাফ পর্যন্ত যাওয়া যায়। ঢাকার কমলাপুর থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় শ্যামলী, হানিফ, ইউনিক, সেন্ট মার্টিন পরিবহন সহ বেশ কিছু বাস সরাসরি টেকনাফের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। এই বাসগুলো সাধারণত সকালে টেকনাফ পৌঁছে যায়। সময় লাগে প্রায় ১০ ঘণ্টা এবং ভাড়া প্রায় ৮০০-১৫০০ টাকা।
কক্সবাজার থেকে যেতে চাইলে সকাল ৫ টার আগেই যাত্রা শুরু করতে হবে। এক্ষেত্রে বাস, মাইক্রো বা চান্দের গাড়ি চড়ে যেতে পারেন টেকনাফ পর্যন্ত। তবে ভালো হয় আগেরদিন রাত টেকনাফে চলে আসলে, সেক্ষেত্রে জাহাজ মিস করার আশঙ্কা থাকবে না। টেকনাফেও থাকার জন্য ভালো মানের বেশ কিছু হোটেল আছে।

জাহাজে সেন্ট মার্টিনঃ
টেকনাফের সেন্ট মার্টিন ঘাট থেকে বেশ কিছু জাহাজ সকাল ৯টায় সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়, যা পৌছায় ১২ টার দিকে। এটি আবার ফিরে আসে ৩ টার দিকে সেন্ট মার্টিন থেকে। যারা দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসতে চান, তারা জাহাজে যাতায়াত করতে পারেন। ভাড়া ১০০০-১৫০০ টাকা আসা যাওয়া। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জাহাজ চলাচল করে না।
ট্রলারে সেন্ট মার্টিনঃ
যারা সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের রোমাঞ্চ উপভোগ করতে চান বা যারা জাহাজ মিস করে ফেলবেন কিংবা যারা খরচ সাশ্রয় করতে চান তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা হচ্ছে ট্রলার। স্থানীয়রা ট্রলারেই সবসময় যাতায়াত করে। তাই একটু ভয় লাগলেও ট্রলারগুলো বেশ নিরাপদেই আপনাকে পৌঁছে দেবে নারকেল জিঞ্জিরায়। সাধারণত বেলা ১১টা থেকে ১টার মধ্যে কয়েকটি ট্রলার ছেড়ে যায় টেকনাফের ট্রলার ঘাট থেকে। সময় লাগে ৪ ঘণ্টা, ভাড়া ২৫০ টাকা। তবে টুরিস্ট সিজনে ৪০০ টাকা পর্যন্ত নিতে পারে। ট্রলার সারা বছরই সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশ্যে চলাচল করে।

কোথায় থাকবেনঃ
সেন্ট মার্টিনে হোটেল-রিসোর্টের অভাব নেই। আপনি জাহাজঘাটে নামলেই দেখবেন দালালে ঘিরে ধরেছে আপনাকে। কারও কথায় কান না দিয়ে সোজা হাঁটা দিন। দ্বীপের পশ্চিম সৈকতে চলে যান। কারণ দ্বীপ থেকে সমুদ্র দেখার এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান। সৈকতের কাছেই অনেকগুলো হোটেল পেয়ে যাবেন। অথবা আগেই গুগল করে আপনার পছন্দের হোটেল ঠিক করে নিতে পারেন। দামদর করে একটা হোটেলে উঠে পড়ুন। ভাড়া সিজন ভেদে উঠানামা করে। সিজনে ১০০০-২০০০ টাকা, আর অফ সিজনে ৫০০-১০০০ টাকায় দুজনের একটি রুম পেয়ে যাবেন। তবে এক রুমে ৩-৪ জনও থাকতে পারবেন, সেক্ষেত্রে মাথা প্রতি ভাড়া কম পড়বে। উঠার আগে অবশ্যই জেনারেটর সুবিধা কতক্ষণ দেবে জিজ্ঞেস করে নেবেন।
কী খাবেনঃ সেন্ট মার্টিনে গেলে অবশ্যই বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছের স্বাদ নিতে ভুলবেন না। ঘাটের কাছেই অনেকগুলো খাবারের দোকান আছে, সেখানেই অনেক পদের সামুদ্রিক মাছ, কাঁকড়া, স্কুইড ইত্যাদি পেয়ে যাবেন। বিকেল বেলা মাছের বাজার বসে। সেখান থেকে পছন্দমত তাজা মাছ কিনে রেস্টুরেন্টে দিলে ওরা বারবিকিউ বা ফ্রাই করে দেবে অল্প খরচে। সেন্ট মার্টিনের ডাব খেতে কিন্তু ভুলবেন না। আসার সময় শুঁটকি কিনে নিতে পারেন।

কী কী দেখবেনঃ
১। পুর্বের সৈকতে সূর্যোদয় এবং পশ্চিম সৈকতে সূর্যাস্ত
২। নারকেল বাগান
৩। পশ্চিমের পাথুরে সৈকত
৪। দ্বীপের দক্ষিণে কেওড়াবন
৫। ছেঁড়া দ্বীপ
৬। জেলে পাড়া ও শুঁটকি আড়ত
যা করবেন
১। প্রচুর ডাব খাবেন, ডাব তুলনামূলক সস্তা। ভালো হয় নিজেরাই গৃহস্তের বাড়ি গিয়ে তাজা ডাব পাড়িয়ে খাবেন।
২। সৈকতে হাঁটেতে গেলে পা কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই অবশ্যই স্পঞ্জ স্যান্ডেল পরে হাঁটতে বের হবেন।
৩। চেষ্টা করবেন ভোর বেলা উঠে পূবের সৈকত ধরে সূর্যোদয় দেখতে দেখতে ছেঁড়া দ্বীপ হেঁটে যেতে। ছেঁড়া দ্বীপ দেখে পশ্চিমের সৈকত ধরে ফিরে আসুন। নিশ্চয়তা দিচ্ছে এটা হবে আপনার জীবনের সেরা হাঁটার অভিজ্ঞতা।
৪। সানগ্লাস আর হ্যাট অবশ্যই সাথে নিবেন।
৫। জোয়ার-ভাটার সময় হিসেব করে ছেঁড়া দ্বীপে যাবেন।
যা করবেন নাঃ
১। দ্বীপে যে কোন ধরণের বর্জ্য ফেলা থেকে বিরত থাকুন। আপনিও এই দ্বীপের জীববৈচিত্র ধ্বংসে ভূমিকা রাখবেন না।
২। স্থানীয়দেরকে নিয়ে হাসি-তামাশা করবেন না। তাদের সাথে অযথা সাথে কোন বিষয়ে বিতর্কে জড়াবেন না।
ছবিঃ জোবায়ের রায়হান
আরও ভিজিট করুনঃ কাপ্তাই লেক