
সারা পৃথিবীতে চাঁদপুর পরিচিত সেরা স্বাদের ইলিশের জন্য। তবে শুধু ইলিশ নয়, দেশের প্রথম ব্র্যান্ডিং জেলা চাঁদপুর বহু ঐতিহাসিক স্থাপত্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মেলা, রথযাত্রা ও লোকশিল্পের জন্যও বিখ্যাত। যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় প্রতি বছর দেশ-বিদেশের বহু মানুষ চাঁদপুরে বেড়াতে যান। আপনিও সময় করে পরিবার বা বন্ধুদের নিয়ে বেড়িয়ে আসতে পারেন ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর।
ইতিহাস বলছে, বার ভূঁইয়াদের শাসনামলে বিক্রমপুরের চাঁদরায় ছিলেন এই অঞ্চলের জমিদার, তাঁর নামেই এই জেলার নামকরণ করা হয়। অন্য জনশ্রুতি অনুসারে, চাঁদ ফকির নামে জনৈক দরবেশের নামানুসারে এ অঞ্চলের নাম হয় চাঁদপুর। কারো কারো মতে, শাহ আহমেদ চাঁদ নামে একজন মোগল প্রশাসক দিল্লী থেকে পনের শতকে এখানে এসে একটি নদীবন্দর স্থাপন করেছিলেন। তার নামানুসারে এই জেলার নাম নাম হয়েছে চাঁদপুর। তবে নামকরণের ইতিহাস যাই হোক না কেন, প্রাচীন সমতটের অংশ চাঁদপুরে জনবসতির ইতিহাস কয়েক হাজার বছর পুরনো। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৭৮ সালে প্রথম চাঁদপুর মহকুমার সৃষ্টি হয়। চাঁদপুর কুমিল্লা জেলার অংশ ছিল ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত। ১৯৮৪ সালে চাঁদপুর একটি স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
কিভাবে যাবেন
শুধু ঢাকা নয়, বাংলাদেশের যে কোন স্থান থেকেই চাঁদপুরে যাওয়া বেশ সহজ। বিশেষ করে নদীপথে যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত, সময় ও ব্যয়-সাশ্রয়ী। চাঁদপুরের অধিবাসীগণ স্থলপথের চেয়ে জলপথে যাতায়াতকেই বেশি প্রাধান্য দেন। এছাড়া চাঁদপুরে সীমিত আকারে রেল যোগাযোগও আছে।
জলপথে
ঢাকার সদরঘাট থেকে প্রতিদিন চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে এমভি সোনার তরী, ঈগল, আল-বোরাকসহ বিআইডব্লিউটিএর অনেকগুলো লঞ্চ ছেড়ে যায়। এর যে কোন একটিতে চড়ে মাত্র ৩-৪ ঘণ্টায় চাঁদপুর যাওয়া যায়। ভাড়া ডেকে শ্রেণিভেদে ১০০-৩০০ টাকা এবং কেবিনে ৫০০-২০০০ টাকা পর্যন্ত। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, ভোলাসহ অন্যান্য নদীবন্দর থেকেও চাঁদপুরে বেশ কিছু লঞ্চ চলাচল করে।
সড়কপথে
ঢাকার সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন অসংখ্য যাত্রীবাহী বাস চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। সময় লাগে ৩-৪ ঘণ্টা। ভাড়া পড়বে ৩০০-৪০০ টাকা।
রেলপথে
ঢাকা থেকে চাঁদপুরে সরাসরি রেল যোগাযোগ নেই, তবে চট্টগ্রাম থেকে মেঘনা এক্সপ্রেস নামে একটি ট্রেন সপ্তাহে সাতদিনই চলাচল করে। এছাড়া কুমিল্লার লাকসাম স্টেশন থেকেও কয়েকটি লোকাল ও কমিউটার ট্রেন চলাচল করে।
কী কী দেখবেন

রাস্তি শাহ মাজারঃ রাস্তি শাহ একজন বিখ্যাত আউলিয়া ছিলেন। হযরত শাহজালাল যেই ১২ জন ইসলাম ধর্ম প্রচারককে সঙ্গে নিয়ে এ অঞ্চলে আসেন, রাস্তি শাহ্ তাদের একজন ছিলেন। ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি ৭৩৮ বঙ্গাব্দে প্রথম ইয়েমেন থেকে এদেশে আসেন। তাঁর নামেই শাহরাস্তি উপজেলার নামকরণ করা হয়। শাহরাস্তি উপজেলার শ্রীপুর গ্রামে রাস্তি শাহ্ এর মাজার অবস্থিত।
মাজার সংলগ্ন একটি প্রাচীন তিন গম্বুজ মসজিদ রয়েছে। কথিত আছে রাস্তি শাহের মৃত্যুর সাড়ে তিনশ’ বছর পর সুবেদার শায়েস্তা খানের কন্যা পরী বিবির আদেশে কাজী গোলাম রসুল নামে এক ব্যক্তি মসজিদটি নির্মাণ করেন। প্রতি বছর মাঘ মাসের শেষ বৃহস্পতিবার এখানে বার্ষিক সম্মেলন (ওরস) অনুষ্ঠিত হয়। যাতে দেশ-বিদেশ হতে প্রচুর ভক্তের সমাগম ঘটে।

রূপসা জমিদার বাড়িঃ জেলা সদর থেকে বাস বা সিএনজি অটোরিকশায় ফরিদ্গঞ্জ হয়ে রূপসা গেলেই পেয়ে যাবেন রূপসা জমিদার বাড়ি। ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে মোহাম্মদ গাজী রূপসায় জমিদারি প্রবর্তন করলেও তাঁর ছেলে আহমেদ গাজী চৌধুরীর সময়ে জমিদারির প্রসার ঘটে। সাধারণ প্রজাদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় এই জমিদার তাঁর বহু সম্পত্তি মানুষের কল্যানে দান করে গেছেন। এছাড়াও তিনি বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছিলেন।
জমিদার বাড়িটি এখনো নিয়মিত মেরামত ও যত্ন করা হয়, যার ফলে অন্যান্য প্রাচীন প্রাসাদের মত এটি তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি। জমিদার বাড়ির সামনেই আছে বিশাল একটি মাঠ। ভেতরে ইট-সুড়কি দিয়ে তৈরি তিনটি ভবন এখনো বেশ সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে। ভবনগুলোতে এখনো জমিদার বাড়ির তৎকালীন কর্মচারীদের উত্তরসূরিরা বসবাস করেন। জমিদার বাড়ি সংলগ্ন মসজিদটিও বেশ বিখ্যাত।

শোল্লা জমিদার বাড়িঃ রূপসা থেকে কাছেই আরেকটি জমিদার বাড়ি আছে, নাম শোল্লা জমিদার বাড়ি। এই জমিদারির পত্তন কারা করেছিলেন সেটা নিয়ে বিস্তারিত জানা যায় না। তবে জনশ্রুতি আছে বঙ্গাব্দ তেরো শতকের শেষ দিকে এলাকার চৌধুরী পরিবার এই জমিদারির মালিক ছিলেন। তাদের নামে এলাকায় বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও আছে। দেড়শো বছরেরও বেশি পুরোনো এই জমিদার বাড়িতে এখনো চৌধুরী পরিবার বসবাস করে।

লোহাগড় মঠঃ ফরিদগঞ্জের চান্দ্রা বাজার থেকে দেড় কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে লোহাগড়া গ্রামের মঠটি কিংবদন্তীর সাক্ষী হিসেবে এখনও দাঁড়িয়ে আছে। পরম প্রতাপশালী জমিদার পরিবারের দুই ভাই লোহ ও গহড় তাদের বাড়ীর অবস্থানের নির্দেশিকা স্বরূপ সুউচ্চ মঠটি নির্মাণ করেন। তাদের আর্থিক প্রতিপত্তির নিদর্শণ স্বরূপ মঠের চূড়ায় একটি স্বর্ণদন্ডও স্থাপন করেন। লোহাগড়ে এই দুই ভাইয়ের প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ এখনও বিদ্যমান। এখানে মাটির নীচে একটি গহবর রয়েছে বলে জনশ্রুতি আছে।

হাজীগঞ্জ বড় মসজিদঃ হাজীগঞ্জের ঐতিহাসিক বড় মসজিদটি শুধু হাজীগঞ্জেই নয়, পুরো চাঁদপুরেই বেশ বিখ্যাত। ১৯৩১ সালে আহমদ আলী পাটোয়ারী নামে এক ব্যক্তি মসজিদটি প্রতিষ্ঠাতা করেন। বেশ বড় আয়তনের এই মসজিদে একসাথে প্রায় ১০ হাজার মানুষ নামাজ পড়তে পারে।
সাহেবগঞ্জ পর্তুগীজ দুর্গঃ পঞ্চাদশ শতকের দিকে পর্তুগীজরা ব্যবসায়ীরা তাদের কাজের সুবিধার্থে সাহেবগঞ্জ এলাকায় বসতি গড়ে তোলে। পরবর্তীতে এন্টেনিও ডি সিলভা নামে এক পর্তুগীজ সেনাপতির তত্ত্বাবধানে ১৫৪০-১৫৪৬ সালের দিকে এখানে একটি দুর্গ তৈরি করা হয়। যা পর্তুগীজ দুর্গ নামে পরিচিতি লাভ করে। দুর্গটির আয়তন ছিল প্রায় দুই শত একর। দুর্গে হাতি রাখার জন্য হাতিশাল ও বেশ কিছু সুড়ঙ্গপথও তৈরি করা হয়েছিল। দুর্গটি এখনো টিকে থাকলেও যত্ন আর সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ হয়ে গেছে।
রক্তধারা স্মৃতিসৌধঃ রক্তধারা স্মৃতিসৌধ ও সংলগ্ন পার্ককে বর্তমান চাঁদপুরের আইকন বলা যায়। তিন নদীর মোহনায় অপূর্ব পরিবেশে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মৃতিতে নির্মিত এই স্মৃতিসৌধ ও পার্ক দেশ বিদেশের বহু মানুষকে আকর্ষণ করে। পদ্মা, ডাকাতিয়া ও মেঘনা নদীর মিলনস্থল উপভোগ করার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান এটি। বিকেলে তিন নদীর বুকে সূর্যাস্তও দেখা যায় এখান থেকে। চাইলে নৌকা ভাড়া করে এখান থেকে তিন নদীর মোহনায় ঘুরেও আসতে পারবেন।
আরও যা দেখতে পারেন
ইলিশ চত্বর, কড়ৈতলী জমিদার বাড়ি, গজরা জমিদার বাড়ি, গুরুর চর, চাঁদপুর বন্দর, বলাখাল জমিদার বাড়ি, বড়কুল জমিদার বাড়ি, বোয়ালিয়া জমিদার বাড়ি ও মত্স্য জাদুঘর।
কোথায় থাকবেন
চাঁদপুরে রাত্রিযাপনের জন্য হোটেল প্রিন্স, রজনীগন্ধাসহ বেশ কিছু আবাসিক হোটেল রয়েছে। এছাড়া অনুমতি নিয়ে জেলা পরিষদের গেস্ট হাউস ও উপজেলা ডাক বাংলোতেও থাকা যায়। ভাড়া পড়বে ৫০০-১৫০০ টাকা।
কী কী খাবেন
ইলিশ মাছঃ চাঁদপুরে যাবেন অথচ প্রাণভরে ইলিশ খাবেন না তা তো হয় না! এখানকার প্রায় সব রেস্টুরেন্টেই ইলিশের নানা সুস্বাদু পদ পাওয়া যায়। আপনার পছন্দ মত ইলিশের পদ দিয়ে ভুঁড়িভোজ করে নিতে ভুলবেন না। তাজা ইলিশের জন্য শহরের বড় স্টেশন ও লঞ্চঘাট সংলগ্ন রেস্টুরেন্টগুলোতে যেতে পারেন। মানভেদে ইলিশের বিভিন্ন পদ দিয়ে ভাত খেতে ১৫০-৪০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হতে পারে। ইলিশ খাওয়ার পাশাপাশি সস্তায় কিনেও নিয়ে যেতে পারেন বাড়ির জন্য। এছাড়াও চাঁদপুরে ঘুরতে গেলে ফরিদগঞ্জের বিখ্যাত আউয়ালের মিষ্টি, মৌসুমির মিষ্টি এবং ‘ওয়ান মিনিট আইসক্রিম’ চেখে দেখতে ভুলবেন না।
যা করবেন না
১। স্থানীয় সংস্কৃতি ও ভাষার প্রতি অশ্রদ্ধা/ঘৃণা প্রদর্শন করবেন না।
২। নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া যত্রতত্র বর্জ্য ফেলা থেকে বিরত থাকুন।
ছবিঃ মাহবুব পাঠান
আরও ভিজিট করুনঃ নিঝুম দ্বীপ