
সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চল দেশ-বিদেশের প্রচুর দর্শনার্থীকে আকর্ষণ করে। বিশেষকরে শীতের পাখি দেখার জন্য প্রতি বছর বহু মানুষের আগমন ঘটে টাঙ্গুয়ার হাওরকে কেন্দ্র করে। তবে শুধু টাঙ্গুয়ার হাওরই নয়, এখানে এলে একসাথে অনেকগুলো বিখ্যাত প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখার সুযোগ পেয়ে যাবেন। সাথে পাবেন নৌকায় হাওরে রাত কাটানোর অপূর্ব সুযোগ। তাই দেখে নিন টাঙ্গুয়ার হাওরে ২ দিনের নৌকা ভ্রমণ প্ল্যান।
বাজেট ২৫০০-৩০০০ টাকা
রুট প্ল্যান ঢাকা-সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর-টাঙ্গুয়ার হাওর-টেকেরঘাট-টাঙ্গুয়ার হাওর-তাহিরপুর-সুনামগঞ্জ-ঢাকা।
কি কি দেখবেন হাসন রাজার বাড়ি, টাঙ্গুয়ার হাওড়, শিমুলবাগান, টেকেরঘাট, বারেক টিলা, জাদুকাটা নদী চানপুর ঝর্ণা, লাকমা ছড়া, নীলাদ্রি লেক
ট্যুর প্ল্যান
সাধারণত সাপ্তাহিক ও অন্যান্য সরকারি ছুটির দিনগুলোতে আমরা ঘোরাঘুরির প্ল্যান করে থাকি। সেজন্য আমরা এখানে বৃহস্পতিবার রাত থেকে রবিবার ভোর পর্যন্ত ৬-৭ জনের গ্রুপ ট্যুরের প্ল্যান সাজিয়েছি। আপনি চাইলে আপনার সুবিধামত দিন বেছে নিতে পারেন।
বৃহস্পতিবার রাত ১০-১২টার মধ্যে ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করবেন। ঢাকার সায়দাবাদ, কমলাপুর ও মহাখালী থেকে প্রতিদিন সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে অসংখ্য বাস ছেড়ে যায়। ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জের ভাড়া শ্রেণিভেদে ৫০০-৮০০ টাকা।
১ম দিন (শুক্রবার)
পথে কোন সমস্যা না হলে পরদিন শুক্রবার ভোরেই পৌঁছে যাবেন সুনামগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড। সকালের নাস্তা করার জন্য বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পেয়ে যাবেন বেশ কিছু রেস্টুরেন্ট। আপনার পছন্দ অনুযায়ী নাস্তা সেরে কিছু সময় নিয়ে ঘুরে আসুন বিখ্যাত মরমী সাধক হাসন রাজার বাড়ি। হাসন রাজার বাড়ি বাস স্ট্যান্ডের কাছেই, মাত্র কয়েক মিনিট হেঁটেই যাওয়া যায়। তবে সময় স্বল্পতা থাকলে সরাসরি তাহিরপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে পারেন।
বাস স্ট্যান্ড থেকে ১০ মিনিট হেঁটে শহরের বড় ব্রিজের কাছে পেয়ে যাবেন তাহিরপুর যাওয়ার গাড়ি। ১০ জনের অধিক হলে লেগুনা ভাড়া করতে পারেন। আর ৪-৫ জন হলে সিএনজি অটোরিকশা নিয়েও যেতে পারবেন। ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ১০০-১৩০ টাকা। তাহিরপুর পৌঁছাতে সময় লাগবে দেড় ঘণ্টার মত।
তাহিরপুর
তাহিরপুর বাজারে নেমে সরাসরি চলে যাবেন নৌকা ঘাটে। সেখানে দেখবেন বিভিন্ন আকৃতির প্রচুর নৌকা অপেক্ষা করছে। আপনাদের দলের আকার অনুযায়ী দুইদিন ও একরাতের জন্য একটি নৌকা ভাড়া করে নিন। ভাড়া করার আগে নৌকায় রাতে ঘুমানো ও বাথরুমের ব্যবস্থা আছে কিনা নিশ্চিত হয়ে নেবেন। ভাড়া নেবে নৌকাভেদে ৩৫০০-৮০০০ হাজার পর্যন্ত। তবে ছুটির দিনগুলোতে ভাড়া তুলনামূলক বেশি হতে পারে। তাই নৌকা ঠিক করার আগে দামাদামি করে নেবেন। যারা সাঁতার জানেন না তাদের জন্য লাইফ ভেস্ট ভাড়া পাওয়া যায় ৫০-৬০ টাকায়।
নৌকায় রান্না ও খাওয়া
নৌকায় উঠার আগে ঠিক করুন এই দুই দিন আর এক রাতের খাবারের ব্যবস্থা কিভাবে করবেন। যেহেতু দুই দিনের (শুক্রবার দিন, শুক্রবার রাত ও শনিবার দিন) জন্য নৌকা ভাড়া করবেন এবং হাওর এলাকায় ভেতরের দিকে তেমন রেস্টুরেন্ট নেই। যেগুলো আছে সেগুলোতে খাবারের দাম নেবে বেশি। তাই আপনারা তাহিরপুর বাজার থেকে প্যাকেটজাত খাবার নিয়ে নিতে পারেন। তবে প্রায় সব নৌকায় রান্না করার ব্যবস্থা থাকে, তাই চাইলে রান্নার উপকরণ সংগ্রহ করে নৌকায় ভাসতে ভাসতে রান্না করতে পারেন। এটাই সবচেয়ে ভালো উপায়।
নৌকায় রান্না করার জন্য ভাড়ার অতিরিক্ত ৭০০-১০০০ টাকা খরচ হবে। তবে আপনাকে রান্নার ঝামেলায় যেতে হবে না। নৌকার লোকই রান্না করে দেবে।
টাঙ্গুয়ার হাওরে যাত্রা শুরু
সব প্রস্তুতি দ্রুত শেষ করে সকাল ১০টার মধ্যেই যাত্রা শুরু করার চেষ্টা করুন। বর্ষাকালে বিশাল হাওর কূলহীন সমুদ্রের মত দেখায়। নৌকায় ভেসে ভেসে অপুর্ব টাঙ্গুয়ার হাওর দেখতে দেখতে চলে যান ওয়াচ টাওয়ার এলাকায়। ওয়াচ টাওয়ারের উপর থেকে হাওরের বহুদুর পর্যন্ত দেখা যায়। চাইলে সেখান থেকে নৌকা নিয়ে বাদাবনের ভেতরে ঘুরে আসতে পারেন। এদিক সেদিক ঘুরতে ঘুরতে দুপুর হয়ে গেলে নৌকায় রান্না করা খাবার খেয়ে আবার যাত্রা শুরু করুন টাকেরঘাটের দিকে।
টেকেরঘাটতে
বিকেলের আগেই পৌঁছে যাবেন টেকেরঘাটে। নৌকা থেকে নেমে দেখে আসুন নীলাদ্রি লেক ও লাখমাছড়া ঝর্ণা দেখে সন্ধ্যার আগেই নৌকায় ফিরে আসুন। রাতের খাবারের জন্য বাজার করতে চাইলে টেকেরঘাট বাজারেই সবকিছু পেয়ে যাবেন। অথৈ হাওরের অপূর্ব রাতটা বৃষ্টি বা আকাশের তারা দেখতে দেখতে কাটিয়ে দিন।
২য় দিন (শনিবার)

শুক্রবার সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে টেকেরঘাট বাজারে নেমে নাস্তা করে নিন। বাজারেই বারেকটিলা পর্যন্ত ঘুরে আসার বাইক পেয়ে যাবেন, ভাড়া নেবে জনপ্রতি ২০০-৩০০ টাকা। বারেক টিলা যাওয়ার পথে দেখে নিতে পারবেন শিমুল বাগান, জাদুকাটা নদী ও চানপুর ঝর্ণা। বাইক চালক আপনাকে সবগুলো স্পট ঘুরে ঘুরে দেখাবে।
দুপুরের মধ্যে সব স্পট দেখা হয়ে গেলে টেকেরঘাটে ফিরে নীলাদ্রি লেকের স্বচ্ছ টলটলে জলে গোসল করে আসতে পারেন। তবে যারা সাঁতার জানেন না, তারা অবশ্যই লাইফ ভেস্ট পরে পানিতে নামবেন। নীলাদ্রি লেকের পানির গভীরতা অনেক বেশি। নৌকায় রান্না না করলে টেকেরঘাট বাজারের যে কোন রেস্টুরেন্টে নানা রকম দেশি মাছের পদ দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিতে পারেন।
তাহিরপুরে ফেরা
খাওয়া শেষে নৌকায় ফিরে ৩টার দিকে ফেরার যাত্রা শুরু করুন। হাওরের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে ফিরে আসুন তাহিরপুর। তাহিরপুর থেকে আগের মত লেগুনা বা সিএনজি অটোরিকশায় সুনামগঞ্জ সদর গিয়ে ফিরে আসতে পারবেন। চেষ্টা করুন সন্ধ্যার আগেই সুনামগঞ্জ পৌঁছাতে। যারা যাওয়ার পথে হাসন রাজার বাড়ি দেখে যেতে পারেন নি, তারা ফিরতি পথে দেখে যেতে পারেন।
সুনামগঞ্জ বাস স্ট্যান্ড থেকে রাতের গাড়িতে ঢাকায় ফিরে আসতে পারবেন। যাদের রবিবারে অফিস/ক্লাস আছে, তারা সহজেই ঢাকায় ফিরে কাজে চলে যেতে পারবেন।
যা যা সঙ্গে নেবেন
১। ফোন/ক্যামেরা রাখার জন্য ওয়াটারপ্রুফ প্লাস্টিক ব্যাগ/জিপলক ব্যাগ
২। পর্যাপ্ত খাবার পানি
৩। পাওয়ার ব্যাংক
৪। সাঁতার কাটার জন্য অতিরিক্ত কাপড়
৫। হাওরে মাছ ধরতে চাইলে ছিপ ও অন্যান্য উপকরণ
৭। লাইফ ভেস্ট/জ্যাকেট
৮। টর্চ লাইট ও ম্যাচ
৯। রেইনকোট/ছাতা
১০। প্লাস্টিক/রাবারের স্যান্ডেল
মনে রাখুন
১। হাওরের পানিতে কোন ধরণের ময়লা ফেলবেন না। ময়লা ফেলার জন্য বড় ওয়েস্ট ব্যাগ সঙ্গে রাখুন। ব্যবহার শেষে তাহিরপুর বাজারে এসে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে দিন।
২। রাতের বেলা হাওরে চিৎকার-চেঁচামেচি বা উচ্চস্বরে গান বাজাবেন না।
৩। সম্ভব হলে তাহিরপুর থানাকে আপনাদের পরিচয় ও অবস্থান সম্পর্কে তথ্য দিয়ে রাখুন।
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ Muhammad A. Zahid, Mohammad Tauheed, Abu Hasan Mehedi, Dr. Rasel
আরও ভিজিট করুনঃ মহামায়া লেক, চট্টগ্রাম