
শোয়াইব মাহমুদঃ টাংগুয়ার হাওরে যাওয়ার প্ল্যান করছি গত তিন বছর ধরে। কিন্তু যাওয়া হচ্ছিলো না। নানা কারণে পিছিয়ে যাচ্ছিলো। এবার অবশেষে হলো। ঘোরাঘুরির জন্য অক্টোবর মাস আমার খুব প্রিয়। এসময় বৃষ্টি প্রায় শেষ হয়ে আসে। প্রকৃতি থাকে অনেক সবুজ। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে থাকে। সাথে যদি থাকে ভরা পূর্ণিমা আর হাওরের অন্যতম সুন্দর হাউজবোট “জলযাত্রা”, তাহলে তা অগ্রাহ্য করা অন্যায়। শুরু হল পূর্ণিমায় টাঙ্গুয়ার হাওর বিলাস।
রাত সাড়ে দশটায় ফকিরাপুল থেকে আমরা ১৬ জনের দল শ্যামলী পরিবহনে রওনা হলাম সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে। বাস যখন আমাদের সুনামগঞ্জ শহরে পানশী রেস্টুরেন্টের সামনে নামিয়ে দিলো তখন ভোর সাড়ে ছয়টা। রেস্টুরেন্টে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে খিচুড়ি আর মুরগী ভুনা দিয়ে নাস্তা সেরে চায়ে চুমুক দিতে দিতেই দু’খানা লেগুনা হাজির। ঝটপট নাস্তার বিল মিটিয়ে সবাই লেগুনায় উঠে বসলাম। গন্তব্য তাহিরপুর। লেগুনা চলতে শুরু করা মাত্রই আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামলো। একেবারে আকাশ ফুটো হয়ে মুষলধারে বৃষ্টি। লেগুনার পর্দা নামিয়ে দিয়েও কাজ হচ্ছিলো না। একেকজন ভিজে একাকার। কপালে তখন চিন্তার ভাঁজ। এরকম বৃষ্টি চললে তো ট্রিপটাই মাটি।
দেড় ঘন্টা পর আমরা পৌছালাম আনোয়ারপুর। এটা তাহিরপুরের একটু আগে। এরপর আর গাড়ি যাবে না। কারণ রাস্তা ভাঙ্গা। আমাদের বোটকে তাই আনোয়ারপুর চলে আসতে বললাম। বৃষ্টি ততক্ষণে পুরোপুরি থেমে গেছে। আরেকদফা চা খেতে খেতে আমাদের বোট আনোয়ারপুর চলে আসলো। প্রথম দেখাতেই বোট দেখে মুগ্ধ হলাম। শুরু হলো আমাদের হাওড় যাত্রা।
মিনিট পনের চলার পর বোট পৌছালো তাহিরপুর বাজার। আমাদের আগামী দেড় দিনের যাবতীয় রসদ এখান থেকেই কিনতে হবে। সদ্য হাওড় থেকে ধরে আনা বোয়াল মাছ, পাঁচমিশালি মাছ, হাওরের হাঁস, দেশি মুরগীসহ আরো যা যা দরকার সব কিনতে কিনতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগলো। এগুলো আমাদের বোটের বাবুর্চি মামার হাতে ধরিয়ে দেয়া হলো। মামা কাজে লেগে গেলেন। ততক্ষণে বোট ছেড়ে দেয়া হয়েছে। শুরু হলো আমাদের মূল হাওড় যাত্রা।
যে বৃষ্টি দেখে চিন্তার উদ্রেক হয়েছিলো, সেই বৃষ্টিটাকেই পরে আশীর্বাদ মনে হচ্ছিলো। কারণ, ওই ঘন্টাখানের বৃষ্টির পর দূরের মেঘালয়ের পাহাড়গুলো অনেক বেশি সবুজ হয়ে গিয়েছিলো আর আকাশের রঙ তখন গাঢ় নীল। সাথে তুলার মতো সাদা মেঘগুলো হাতের নাগালে উড়ছিলো। মোট কথা, টাঙ্গুয়ার হাওর তার সমস্ত সৌন্দর্য দিয়ে আমাদের বরণ করেছিলো।
সোয়া একঘন্টা বা তার একটু বেশি সময় পর আমরা পৌছে গেলাম ওয়াচ টাওয়ার। এখানের জলাবন দেখে যে কারো রাতারগুলের কথা মনে পড়বে। ওয়াচ টাওয়ারের ভিড় এড়িয়ে আমাদের বোট জলাবনের একটু ভিতরে ছায়া আছে এমন জায়গায় নোঙর করলো। লাইফ জ্যাকেট পরে সবার পানিতে দাপাদাপি শুরু হয়ে গেলো। কয়েকটা পিচ্চি ততোক্ষণে ছোট ছোট নৌকা নিয়ে আমাদের বোটের পাশে এসে ভীড়েছে। ওদের বোটে উঠে ওয়াচ টাওয়ারের চারপাশের জলাবন ঘুরে দেখা যায়। সাথে বোনাস হিসেবে তাদের গলায় গান শোনা আর ভাসমান চা-বিক্রেতার কাছ থেকে নেয়া চা- সব মিলিয়ে বেশ লাগছিলো।
বাবুর্চি মামা ততক্ষণে দুপুরের খাবার পরিবেশন করে দিয়েছেন। গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের সাথে হাওড়ের তাজা মাছ, আলু ভর্তা, টাকি মাছ ভর্তা আর ডাল। খেয়ে দেয়ে একেকজনের নড়াচড়ার মতো অবস্থা ছিলোনা। আমাদের বোট আবারো চলতে শুরু করলো ট্যাকেরঘাটের উদ্দেশ্যে। চারপাশে যতো দেখছিলাম, ততোই ভালো লাগছিলো। দূরের মেঘালয় পাহাড়গুলোর ক্রমশ কাছে আসতে থাকলো। বিকাল সাড়ে চারটায় আমরা পৌঁছে গেলোম ট্যাকেরঘাট।

ঘাটে নেমে চা খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম শহীদ সিরাজি লেকে। এই লেকটি নিলাদ্রী লেক নামেও পরিচিত। বিকালের স্নিগ্ধ আলো, লেকের নীল পানি আর পাশেই মেঘালয়ের সুউচ্চ পাহাড়-সবমিলিয়ে অসাধারণ একটা বিকাল কাটালাম আমরা। এতোটাই ভালো লেগেছিলো যে তখনি ঠিক করে ফেললাম পরদিন ভোরে আবার আসবো এখানে।
সন্ধ্যা হতেই আকাশে উজ্জ্বল হলুদ রঙের একখানা পূর্ণ চাঁদের দেখা মিললো। ঘাট থেকে ছেড়ে আমাদের বোট একটু দূরে হাওরের মাঝে নোঙর করা হলো। রাতে হাঁস ভুনা দিয়ে ভাত খেয়ে শুরু হলো আমাদের পূর্ণিমা বিলাস, আড্ডা আর গান। রাত দুইটার দিকে সবার মনে হলো, এবার একটু ঘুমানো দরকার।
পরদিন খুব ভোরে আমরা ৫/৬ জন আবার গেলাম নিলাদ্রী লেকে। গতোকাল লেকে ডিঙ্গি নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর লোভ সামলাতে পারলেও, আজ আর পারলাম না। একটা নৌকায় উঠে লেকটার চারপাশ ঘুরে বেড়ালাম। বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে আমাদের বোটের কাছে ফিরে এসে দেখি, বাকিরা সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। সকালের নাস্তা তৈরি হতে আরো আধাঘন্টার মতো লাগবে। সময় নষ্ট না করে বাইকে করে লাকমাছড়া ঘুরে আসলাম। ট্যাকেরঘাট থেকে মিনিট দশেকের মতো লাগে। লাকমাছড়া অনেকটা বিছানাকান্দির মতো। মেঘালয় পাহাড়ের খুব সুন্দর ভিউ পাওয়া যাচ্ছিলো। আধাঘন্টার মতো সময় কাটিয়ে বোটে ফিরে খিচুড়ি, ডিম ভাজা আর মরিচ ভর্তা দিয়ে নাস্তা সেরে নিলাম সবাই।
এবার ট্যাকেরঘাটকে বিদায় জানানোর পালা। আমাদের বোট রওনা হলো শিমুল বাগানের উদ্দেশ্যে। মাঝখানে একদফা মুড়ি মাখা আর চা খাওয়া চললো। শিমুল বাগানের আসল রূপ দেখা যায় শীতের শেষে। তবে এখনকার সৌন্দর্য অন্যরকম। গাছগুলো সবুজ, সজীব। শিমুল বাগান দেখা শেষে বোটে করে আমরা গেলাম বারিক্কা টিলার পাদদেশে জাদুকাটা নদীতে। আজকের গোসল এখানেই হবে। ঘন্টাখানেক পানিতে দাপাদাপি চললো।
বাবুর্চি মামা দুপুরের খাবার দিয়ে দিলেন। এদিনের মেনু ছিলো- আলু ভর্তা, দেশি মুরগীর ঝাল ভুনা, ডাল, ভাত। খাওয়া শেষে আমরা বারিক্কা টিলার উপর থেকে ঘুরে আসলাম। এখান থেকে জাদুকাটা নদী আর মেঘালয়ের পাহাড়গুলোর খুব সুন্দর ভিউ পাওয়া যাচ্ছিলো।
এবার ফেরার পালা। সন্ধ্যার আগেই আমরা তাহিরপুর পার হয়ে আনোয়ারপুর পৌছে গেলাম। তারপর লেগুনায় করে সুনামগঞ্জ শহরে পৌছে রাতের খাবার খেলাম পানশীতে। হাওরের সর্বোচ্চ সৌন্দর্যের সাক্ষী হয়ে ঢাকার বাসে চেপে বসলাম।
পরিশেষে, পরিবেশের প্রতি খেয়াল রাখুন, ময়লা-আবর্জনা নির্ধারিত স্থানে ফেলুন।
আরও পড়ুনঃ বিছনাকান্দি থেকে পান্তুমাই ট্র্যাকিং