রেমা-কালেঙ্গা অভিযান

rema-kalenga-jungle-bd

শোয়াইব মাহমুদঃ টানা কয়েকটা ট্রিপ পাহাড়ে দেয়ার পর ভাবলাম এবার জংগলে যাবো। সুন্দরবন, লাউয়াছড়া, সাতছড়ি আগেই ঘুরেছি। তাই প্লান করলাম এবার রেমা কালেঙ্গা কভার করবো। কভার করবো বলাটা আসলে রীতিমতো পাপ। কারণ সুন্দরবনের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের আয়তন প্রায় ১৭৯৫ হেক্টর!

সংগী-সাথীদের প্লানের কথা জানালে তারাও দু’পায়ে রাজি হয়ে গেলো। যেহেতু আমরা ১০ জন, তাই বাসের ঝামেলায় না গিয়ে দুইদিনের জন্য একটা মাইক্রো ভাড়া করে ফেললাম। শুক্রবার খুব ভোরে রওনা হওয়ার কথা থাকলেও, একজনের কাজ পরে যাওয়ায় আমাদের রওনা হতে হলো দুপুর দুইটায়।

পথে বার দুয়েক ব্রেক নিয়ে আমরা যখন রেমা কালেঙ্গার মূল ফটকের সামনে পৌছালাম, তখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। রেমা কালেঙ্গায় থাকার মতো তিন-চারখানা কটেজ আছে। যার মধ্যে দুইটা মূল গেটের বাইরে অবস্থিত। আমি ঢাকায় থাকতেই সিএমসি রিসোর্টে কথা বলে ওদের যে চারটা রুম ছিলো, সেগুলো বুক দিয়ে রেখেছিলাম। এই কটেজটা বাকিগুলোর তুলনায় বেশ ভালো আর পরিপাটি। সবচেয়ে বড় কথা, এটা একদম জংগলের ভিতরে অবস্থিত। এর সামনে অনেক খোলামেলা জায়গা আছে। চাইলে ক্যাম্পিং, বারবিকিউ সবই করা যায়।

আমরা রুমে পৌছে সবাই ফ্রেশ হয়ে হালকা নাস্তা করে নিলাম। আমাদের গাইড নোমান ভাই ততোক্ষণে যোগ দিয়েছেন আমাদের সাথে। ঢাকায় থাকতেই নোমান ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করে গিয়েছিলাম। উনি আগে থেকে আমাদের রাতের খাবারের মেন্যু জেনে নিয়ে সে অনুযায়ী সব গুছিয়ে রেখেছিলেন।

রাতের আকাশে তখন কোটি কোটি তারার মেলা আর চাঁদের উথাল পাথাল আলো। কানে আসছে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। বুনো হাওয়া বইছিলো চারপাশে। এরকম পরিবেশে ক্যাম্পফায়ার, আড্ডা আর বারবিকিউ চললো সমানতালে। ডিনার শেষে অনেকক্ষণ গল্পগুজব চলার পর সাথের মেয়েরা আর বাচ্চারা ঘুমাতে চলে গেলো। আমরা কয়েকজন নিশাচর তখন অন্ধকার জংগলে কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করলাম। বারবার মনে হচ্ছিলো এই রাতে ঘুমালেই লস…

আগের রাতে ঘুমাতে দেরি হলেও ভোরে ঘুম থেকে উঠতে ভুল হলো না। রেমা কালেঙ্গার পুব আকাশে যখন সূর্য ওঠে, তখন সবকিছু অদ্ভুত সুন্দর দেখায়। কুয়াশামাখা গাছপালার সমাহার আর অজস্র নাম জানা-অজানা পাখির ডাকে মুখর ছিলো চারপাশ। বেশ খানিকক্ষণ আশেপাশে ঘুরে কটেজে এসে দেখি সকালের নাস্তা রেডি।

গরম গরম ডিম ভাজা দিয়ে ভুনা খিচুড়ি খেয়ে আমরা বের হলাম রেমা কালেঙ্গা জংগল ট্রেকিং-এ। ছোট একটা বাশেঁর সাকো পার হয়ে আমরা আমরা অভয়ারণ্যের ভিতরে ঢুকে পড়লাম। চারপাশে বড় বড় গাছ দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম। নোমান ভাই নানারকম তথ্য দিচ্ছিলেন আর পথ চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। নানারকম পোকামাকড় আর পাখির শব্দ কানে আসছিলো। খানিক বাদেই গাছের ডালে দেখা পেলাম কয়েকটা বানরের। এরপর আরেকটু গহীনে যাওয়ার পর দেখা মিললো মুখ পোড়া হনুমান আর চশমা পড়া হনুমানের। হাঁটতে হাঁটতে একটু পরপরই আমরা ঝিরির দেখা পাচ্ছিলাম। ঝিরির শীতল পানিতে পা ভিজিয়ে আবার এগিয়ে চলছিলাম।

বেশ খানিকক্ষণ এভাবে চলার পর আমরা সমতল একটা জায়গা দেখে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে, হালকা খেয়ে দেয়ে আবার চলা শুরু করলাম। এবার জংগল যেন আরো ঘন। নানারকম জংলী ফুল ফুটে আছে এখানে সেখানে। এরপর আবার সমতল। যেদিকে চোখ যায় সবুজ ধানক্ষেত। ধানক্ষেত পেরিয়ে কিছুদূর আগানোর পর আমরা পৌছালাম ত্রিপুরা পাড়ায়। খুব সুন্দর, পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন একটা পাড়া। মাটির বড় বড় ঘর। মেয়েরা কেউ কেউ তাঁতের কাজ করছে। খানিকক্ষণ পাড়ায় জিরিয়ে আবার হাঁটা। এরপর আমরা পৌছালাম একটা লেকের ধারে। লেকের পাশেই ওয়াচ টাওয়ার। এখান থেকে বনের সুন্দর একটা ভিউ পাওয়া যাচ্ছিলো। ওয়াচ টাওয়ার থেকে খানিক এগোনোর পর বিশাল একটা লেবুর বাগান পড়লো। যতোই দেখছিলাম সবকিছু, মুগ্ধতা শুধুই বাড়ছিলো।

এভাবে প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা জংগলে কাটিয়ে আমরা আমাদের কটেজে ফিরে আসলাম। সবাই গোসল সেরে আসতে আসতে নোমান ভাই জানালো, দুপুরের খাবার প্রস্তুত। ভাত, আলু ভর্তা, সিদল শুঁটকি ভর্তা, দেশি মুরগি ভুনা আর ডাল দিয়ে জম্পেশ খাওয়া-দাওয়া হলো। এরপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বিকাল চারটায় আমরা রেমা-কালেঙ্গাকে বিদায় জানালাম। ফেরার সময় মন খারাপ হচ্ছিলো। অন্তত আরেকটা দিন এখানে থেকে যেতে পারলে মন ভরতো।

ফেরার সময় আমরা বিকালটা কাটিয়েছিলাম একটা সুন্দর চা বাগানে। চুনারুঘাটের পর থেকে মাধবপুর যাবার রাস্তার প্রায় পুরোটাই চা বাগান। চা বাগানে সূর্যাস্ত দেখে আমরা ঢাকার পথ ধরলাম।

কিভাবে যাবেনঃ ঢাকা থেকে বাসে বা ট্রেনে শায়েস্তাগঞ্জ এসে সিএনজি নিয়ে চুনারুঘাট হয়ে রেমা-কালেঙ্গা যাওয়া যায়। অথবা আমাদের মতো সরাসরি মাইক্রো নিয়েও যেতে পারেন। রেমা-কালেঙ্গা যাবার শেষ ৪/৫ কিলো রাস্তা কাঁচা আর এবড়ো-থেবড়ো।

লেখাঃ শোয়াইব মাহমুদ, ছবিঃ নিউজ অফ বাংলা

আরও দেখুনঃ বিছনাকান্দি থেকে পান্তুমাই ট্রেকিং