আড়িয়াল বিলে একদিন

arial bil-wonderful bangladesh

মুহাম্মদ তৌফিকুর রহমানঃ ঢাকার আসে পাশে কোথায় যাওয়া যায় ? আবিরের এমন প্রশ্নে মাথায় আরিয়াল বিলের কথাটা চলে আসলো। কয়দিন আগে বন্ধুরা সাইকেলে করে সেখানে গিয়েছে বলে মাথায় এসেছে হয়তো। সে যাই হোক, যাওয়ার মত একটা জায়গা পাওয়া গিয়েছে এটাই মূল কথা। সেখানে কিভাবে যাওয়া যায় সেটা নিয়ে ঘাটা ঘাটি করতে গিয়ে দেখলাম সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে মাওয়া গামী কোন বাসে করে যাওয়া। অনেকে নদি পথেও সরাসরি যেতে পারে। তবে আমার মাথায় ঘুরছিল অন্য কিছু। এমনিতে মাথায় ছিল ঢাকা – মাওয়া মহাসড়কের অবস্থা খুব একটা ভালো না। যদিও সেটা এখন ঠিক হয়ে গিয়েছে। তাই বন্ধুদের সাইকেলের রুট সম্পর্কে জিগ্যেস করলাম । তারা খুব বেশি তথ্য দিতে পারলো না । তবে ভাবলাম ঐ পথই ধরবো যা আছে কপালে। গ্রুপে অনেকেই জিগ্যেস করছে কিভাবে কোথায় যাচ্ছি । আমি শুধু বলেছি বছিলা হয়ে যাবো । কিভাবে যাবো সেটা জানি না।

শুক্রবারের সুন্দর সকালে আমরা একে একে মহাম্মরদপুর বাস স্ট্যান্ডে এসে হাজির হলাম। সবার শেষে এসে হাজির হল ইয়াসিন। প্ল্যান হওয়ার সময় খুব নাটক করেছিল সে। ক্লাস নিতে হবে, ভার্সিটি তে মাত্র জয়েন করেছি, হুট হাট চলে আসা যাবে না। সমস্যা হল শুক্রবারেও ওর ক্লাস নেয়া লাগে। এতসব এক্সকিউজ শুনে শিওর ছিলাম ও যাচ্ছে না । তো আমরা এক একজন এক এক জায়গা থেকে মোহাম্মদপুর আসছি। কেউ বনশ্রী, কেউ মিরপুর কেউ উত্তরা। আমি ধানমন্ডি আগে ভাগে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার সাথে রুম্মান, শিশির আর সৌমিক ছিল তখন।

ভেবেছিলাম সকাল সকাল রউনা হয়ে যাবো কিন্তু দূর দুরান্ত থেকে বন্ধুদের আসতে ঘড়ির কাটা ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে। তখনও আবিরের আসা বাকি। ঠিক ঐ মুহূর্তে ইয়াসিন ফোন দিয়ে বলল যে সে আসছে। গাবতলি থেকে সি এন জি তে উঠেছে। সবাই খুব খুশিই হলাম আমরা। একজন পার্মানেন্ট ট্যুর পার্টনারের জন্য অপেক্ষা করাই যায়। প্রায় অনেক্ষন অপেক্ষা করিয়ে আবির আর ইয়াসিন প্রায় একই সময়ে আসলো। এসেই তার নাটকীয় কাহিনী বলা শুরু করলো যে কিভাবে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ম্যানেজ করে তারপর আসতে হয়েছে তাকে। এসব ব্যাপারে যদিও সে খুব পারদর্শী, ভার্সিটি লাইফে সি আর ছিল কি না !

তো আমরা আর দেরি না করে বছিলার জন্য লেগুনায় উঠে পড়লাম। এখানে বলে রাখা ভালো, আমরা সংখায় ছিলাম মোট আট জন। আমাদের এই গ্রুপ একসাথে কোথাও হলে আর রক্ষা নেই। আসে পাশে হাসির শব্দ ছাড়া কিছু শুনতে পাওয়া দায়। লেগুনা আমাদের বছিলার লেগুনা স্ট্যান্ডে নামিয়ে দিলো। খুব একটা সময় লাগে নি। এরপর আমরা একে তাকে জিগ্যেস করে প্রায় শুকিয়ে যাওয়া কোন খালের উপর দাঁড়িয়ে থাকা একটি শুকনো ব্রিজ পার হয়ে সি এন জি ঠিক করে উঠে পড়লাম। গন্তব্য ভাওয়ার ভিটি বাস স্ট্যান্ড। সেখান থেকে নাকি বাস পাওয়া যাবে।

দুটো সি এন জি তে চার জন করে উঠেছিলাম। পথে কেরানীগঞ্জের সৌন্দর্য দেখে খারাপ লাগেনি। বরং ভালোই লেগেছে। এখানে ছোট ছোট পুকুর গুলোয় দেবি বিসর্জন চোখে পড়ার মত। মনে হচ্ছিল সেই রাজা বাদশাদের আমলে চলে গিয়েছি । ঢাকার মত একটা মেগা সিটির ঠিক পাশেই এরকম কিছু আছে, ভাবতে অবাক লাগে। সি এন জি রাইড টা তাই মোটেও খারাপ ছিল সেটা বলা যাবে না। ঠিক নামাজের কিছু আগে আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম।

গন্তব্যে পৌঁছে অনেকটাই হতাশ হতে হল কারন আমরা ঢাকা থেকে খুব একটা দূরে আসি নি এবং সে তুলনায় আমাদের যাতায়াত খরচ বেশি হয়েছে। তার থেকেও বড় কথা যে খারাপ রাস্তা এড়িয়ে যাবার কথা ভেবেছিলাম তার কিছুই হল না। সামনের পথটুকু সেই বাজে রাস্তা। কি আর করার! রাস্তার ওপারে গিয়ে মোটামুটি টাইপের একটা রেস্তোরাঁ থেকে দুপুরের খাবার সেরে আমরা নামাজ পরে নিলাম এবং বাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

সমস্যা হল আমরা কোথায় যাবো সঠিক জানি না। মানে বলতে চাচ্ছি কোথায় নেমে আমরা আরিয়াল বিলের পথ ধরবো সেটা বুঝতে পারছি না। এবং কাউকে বুঝাতেও পারছি না। এখানের কেউ সঠিক বলতে পারে না। অনেকে নাম শুনে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। আড়িয়াল বিল নিয়ে ফেসবুকে ততদিনে কত ছবি দেখলাম অথচ এখানকার মানুষ এই নামের সাথে খুব একটা পরিচিত বলে মনে হল না। অবশেষে বাস কন্ডাক্টর কে জিগ্যেস করে জানা গেলো শ্রীনগর অথবা হাসারা নামক স্থানে নামলে আমাদের জন্য সুবিধে হবে। তবে হাসারার প্রতিই জোর বেশি দিলেন। এই রুটের প্রায় সব বাসই হাসারা এবং শ্রীনগর যায়। তাই দেরি না করে একটা বাসে উঠে গেলাম আমরা। সবাই বসার জন্য সিট পাই নি। কন্ডাক্টর বললেন – বেশি দূর না , চলে এলাম বলে। তবে রাস্তার সেই বেহাল দশা ভুগিয়েছে আমাদের। তবে সে ভোগান্তি এখন আর নেই।

তীব্র রোদের মাঝে হাইওয়ে তে আমাদের নামিয়ে দিলো। এতো সুন্দর রাস্তা! গাড়ি ঘোরাও নেই তেমন। তবে রোদের তাপ খুব বেশি ছিল। মনের মধ্যে আশঙ্কা ছিল – এই তীব্র রোদে বিলে ঘুরে ফিরে কোন আনন্দ আদৌ পাওয়া যাবে কি? খুব করে চাইছিলাম যদি বৃষ্টি হতো! ঝুম বৃষ্টিতে বিলের পানিতে কেমন একটা ছন্দ তৈরি হবে। কিন্তু নাহ! কিসের বৃষ্টি কিসের কি! খা খা রোদ ছাড়া কিচ্ছু না।

আমাদের যেখানে নামিয়ে দিয়েছিল তার গুটি কতক সামনে গিয়ে আমরা রাস্তা পার হয়ে অটো নিলাম দুটো। পাঁচ কি দশ মিনিট লেগেছিল বাজারে পৌঁছাতে। তবে পথের দুপাশের গ্রাম গুলো চোখ জুড়িয়েছিল আমাদের। একটা ব্রিজ পার করেই আমাদের নামিয়ে দিলো। বাজারের দোকান প্রায় সব বন্ধ। শুক্রবার বলে হয়তো। আমরা একটা বন্ধ দোকানের ছাউনিতে বসে রইলাম। কেউ কেউ ছবি তোলায় ব্যাস্ত। এর মাঝে একজন মাঝি এসে আমাদের সাথে কথা বলা শুরু করলো। তার সাথে কথা বলতে না বলতে আরও দুই – তিন জন এসে হাজির হল। তাঁদের মাঝে কে কত কম টাকায় আমাদের বেশি সময় ঘুরাবে সেই তর্ক শুরু হয়ে গেলো। বুঝতে পারলাম, এখান থেকে বিলে ঘুরতে কেউ খুব একটা আসে না। যদিও আমরা শুরুতে যিনি কথা বলেছিলেন তার নৌকাতেই উঠেছিলাম। একটু পরে, রোদের তেজ কমে যাওয়ার পর। মাঝির নাম আরশাদ ভাই। টুরিস্ট টাইপ ছাউনি দেয়া ইঞ্জিন চালিত নৌকা। খারাপ না, তবে ইঞ্জিনের শব্দ টা না থাকলে ভালো হতো।

কিছু চিপস এবং কোক কিনে আমাদের যাত্রা শুরু হল। আচ্ছ ! এই তাহলে আড়িয়াল বিল? “না! বিল আরও সামনে। এখনও আসি নাই বিলে।” আরশাদ ভাইয়ের কথায় বুঝলাম এটা শাখা নদি টাইপ কিছু। তবে সুন্দর। দুই পাশে গ্রামের বাড়ি দেখা যাচ্ছে। ঠিক বইয়ে পড়া সেই – ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় টাইপ। একটা জিনিস দেখে খুব ভালো লাগলো – প্রায় প্রতিটা বাড়ির সাথে ঘাট রয়েছে। এবং এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি তে যেতে এরা এসব নৌকা ব্যাবহার করে। ঘন গাছ পালার ফাঁকে ফাঁকে এসব শান্তির নীড় দেখতে দেখতেই বিলে এসে পরেছিলাম আমরা।

উপরে শরৎ কালের নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা আর নিচে শান্ত নীল জলরাশি। মাঝে মাঝে কোথাও ঝোপের মত কিছু গাছ লতা পাতা ঘাস জড়াজড়ি করে আছে। অদ্ভুত সুন্দর! সবুজ সাদা এবং নীল রঙের এমন কন্ট্রাস্ট মনে হয় শুধু বাংলাদেশেই সম্ভব! কোন দিকে যাওয়া যায়? চারিদিকেই সুন্দর আর সুন্দর। “কোনদিকে যাইবেন – সকলে ঐ দ্বীপের মত একটা জায়গা আছে সেখানে যায় । আসে পাশে ঘুরে । বিল তো মেলা বড়” – কথা গুলো আরশাদ ভাই আমাদের কে উদ্দেশ্য করে বললেন। আমরা সেই দ্বীপের মত একটা জায়গাতেই নামলাম। সেখানে অল্প কিছুক্ষণ ছবি তুলে আবার নৌকায় উঠে পড়লাম। দেখার মত কিছু নেই তেমন। গাছা পালা দিয়ে ঘেরা উঁচু মাটির ঢিবি বলা চলে।

তখনও রোদ কমেনি – তবে বাতাসের কারনে গরম লাগেনি তেমন। আবির বলল – মামা! ইঞ্জিন টা কিছু সময়ের জন্য বন্ধ করে দেন। বিলের একটা ব্যাপার হচ্ছে – স্রোত নেই যে নৌকা ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। আহ ! শান্তি। চারিদিক কোন শব্দ নেই। একদম নিশ্চুপ। চারপাশে জলরাশি আর সবুজ গাছপালা। মাঝে আমরা চুপচাপ নৌকায় বসে আছি। নিরবতার গান যে এতো শ্রুতিমধুর সেটা এসব জায়গায় না আসলে বুঝা যায় না। পাশ দিয়ে বৈঠাবাহী জেলে নৌকা গেলো একটা। দূরে বাঁশের তিনকোনা জাল এর ফ্রেমে দাঁড়িয়ে একজন পর্যবেক্ষণ করছেন। সূর্যটা ঠিক তার মাথার পেছনে। শেষ বিকেলে রঙের এই অপরূপ খেলা নিজের চোখে দেখা সত্যিই প্রশান্তির ব্যাপার। যতক্ষন নৌকায় ছিলাম – সবার সব হাসি গল্প কোথায় যেন হারিয়ে গেলো!

সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে আগে আমরা ঘাটের দিকে রউনা দিলাম আবার। মাঝে এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে ডাক দিচ্ছে পার করে দেয়ার জন্য। ঘাটে নেমে আর দেরি করলাম না। দ্রুত সি এন জি নিয়ে মেইন রোডে চলে এলাম। তখন সবে মাগরিবের আযান দিয়েছে। অন্ধকার নামার আগে আগে উঠে পড়লাম গুলিস্তানের একটা বাসে এবং প্রায় এক ঘণ্টার মাঝে গুলিস্তান। চমৎকার এই দিনটি শেষ হয়েছিল রাজধানি হোটেলে নাস্তা করতে করতে।

ভ্রমণের তারিখ : সেপ্টেম্বর ৬, ২০১৯

রুটঃ গুলিস্তান থেকে মাওয়াগামি যেকোনো বাসে উঠে শ্রীনগর বা হাসারা নামবেন। এরপর রাস্তা পার হলেই সেখানে অটো কিংবা সি এন জি পাবেন । সেখান থেকে স্থানীয় বাজারে নেমে নৌকা ভাড়া পাবেন। তবে বেশিরভাগ মানুষ বোধয় গাদিঘাট থেকে নৌকা ভাড়া করে থাকেন । সদরঘাট থেকে সরাসরি গাদিঘাট যাবার মাধ্যম পাবেন।

খরচ জনপ্রতিঃ ৩৩০ টাকা যদি গুলিস্তান হয়ে যান। ( ৮ জনের জন্য খাওয়া দাওয়ার হিসেব ছাড়া)। নৌকা আপনারা একটু দরদাম করে নিবেন। আমরা প্রায় তিন ঘণ্টা ৭৫০ টাকায় ঠিক করেছিলাম। ঘুরে এসে খুশি হয়ে ৫০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছিলাম।

লেখা ও ছবিঃ মুহাম্মদ তৌফিকুর রহমান

আরও দেখুনঃ প্রাচীন পানাম নগর